হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা, যা মানুষের আত্মিক, সামাজিক, নৈতিক এবং পারিবারিক সব দিকের সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে। ইসলামের এই পরিপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন ধর্মীয় মুবাল্লিগগণ। তারা সমাজে ইসলামী জ্ঞান প্রচার করেন, মানুষকে আল্লাহর পথে ডেকে আনেন এবং নৈতিকতা ও আদর্শের আলো ছড়িয়ে দেন। তবে একজন মুবাল্লিগের শুধু ধর্মীয় জ্ঞান থাকলেই চলবে না; বরং তাঁকে হতে হবে বহু গুণে গুণান্বিত। এই প্রবন্ধে আমরা একজন আদর্শ ধর্মীয় মুবাল্লিগকে কেমন হওয়া উচিত তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো।
১. শিক্ষা (ধর্মীয় ও জেনারেল)
একজন মুবাল্লিগের প্রথম এবং প্রধান যোগ্যতা হলো যথাযথ ধর্মীয় শিক্ষা। কোরআন, হাদীস, ফিকহ, আকাইদ, সিরাতুন্নবী (সা.)—এসব বিষয়ে তার ভালো জ্ঞান থাকতে হবে। একইসাথে বর্তমান যুগের বাস্তবতা বিবেচনায় তার সাধারণ শিক্ষার জ্ঞানও থাকা জরুরি। বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ও বর্তমান যুগের ভাষা ও প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন থাকলে দাওয়াত কার্যক্রম আরও ফলপ্রসূ হয়। জেনারেল শিক্ষার মাধ্যমে তিনি শিক্ষিত সমাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ইসলামকে আধুনিক প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করতে পারবেন।
২. আখলাক (নৈতিক চরিত্র)
একজন মুবাল্লিগের জন্য সর্বোচ্চ গুণ হলো উচ্চ আখলাক। কুরআনে আল্লাহ বলেন,
“আর তুমি তো এক মহান চরিত্রের অধিকারী।” (সূরা আল-কলম: ৪)
নবী করীম (সা.)-এর জীবনের সবচেয়ে বড় দাওয়াত ছিল তাঁর আখলাক। একজন মুবাল্লিগের মধ্যে থাকতে হবে বিনয়, ধৈর্য, সহানুভূতি, ক্ষমাশীলতা, সততা ও নম্রতা। কারণ মানুষ মুখের কথা যত না গ্রহণ করে, আচরণ ও ব্যবহার তত বেশি গ্রহণ করে।
৩. তাবলীগের স্থান সম্পর্কে অবগত
একজন মুবাল্লিগের জন্য তার দাওয়াতের জায়গা, পরিবেশ, সমাজ এবং শ্রোতাদের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা থাকা জরুরি। গ্রাম, শহর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস কিংবা কোনো মিলনমেলা—প্রতিটি স্থানে দাওয়াতের পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তিনি কোথায়, কিভাবে, কী পরিমাণ, কার সামনে কী বলবেন—এটি জানার জন্য বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি।
৪. সাধারণ মানুষের শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে অবগত
শ্রোতাদের শিক্ষাগত মান অনুযায়ী বয়ান বা আলোচনার ধরন নির্ধারণ করাও একজন মুবাল্লিগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। উচ্চ শিক্ষিত, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, সাধারণ গ্রামবাসী, নারী, শিশু—সবার গ্রহণক্ষমতা এক নয়। তাই তাদের মান বুঝে বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারলে দাওয়াত সফল হবে।
৫. শিশুদের জন্য ক্লাস (কোরআন, আকায়েদ, আহকাম ইত্যাদি)
একজন আদর্শ মুবাল্লিগকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরিতে মনোযোগী হতে হবে। শিশুদের জন্য আলাদা ক্লাস ও কার্যক্রম থাকা উচিত। যেমন:
কুরআন শিক্ষার ক্লাস
আকায়েদ ও ঈমানের মৌলিক শিক্ষা
নামাজ, রোজা, ওযু, পবিত্রতা ইত্যাদির আহকাম
নৈতিক গল্প, নবী-রাসূলদের জীবনকাহিনী
শিশুদেরকে ইসলামী পরিবেশে গড়ে তুলতে একজন মুবাল্লিগের নিষ্ঠা ও স্নেহশীলতা খুব দরকার।
৬. বড়দের জন্য ক্লাস (পুরুষ ও মহিলা)
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নিয়মিত ইসলামী শিক্ষা ও আলোচনা ক্লাস থাকা দরকার। পৃথকভাবে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য মাসিক বা সাপ্তাহিকভাবে:
ফিকহ ও হাদীসের আলোচনা
পরিবারে ইসলামের ভূমিকা
নৈতিক উন্নয়নের দিকনির্দেশনা
দাম্পত্য জীবন ও সন্তান প্রতিপালন
সমাজ গঠনমূলক শিক্ষা
মহিলাদের জন্য আলাদা পরিবেশে পর্দার মধ্যে ক্লাস পরিচালনা করলে দাওয়াত আরও বিস্তৃত হবে।
৭. আখলাক সবার জন্য
দাওয়াতের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো সমাজে আখলাক ও আদর্শের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। তাই একজন মুবাল্লিগ সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে আখলাক গঠনের দিকে মনোযোগ দেবেন। শিশু, কিশোর, যুবক, বয়স্ক—সবার মাঝেই ইনসাফ, সহানুভূতি, দয়া, ধৈর্য, আমানতদারি, সত্যবাদিতা ও সদ্ব্যবহারের শিক্ষা দিতে হবে। মানুষ যেন তাঁর কথায় ও আচরণে অনুপ্রাণিত হয়।
শেষ কথা: একজন ধর্মীয় মুবাল্লিগ শুধুমাত্র বক্তা নয়, বরং তিনি একজন দিকনির্দেশক, সমাজ সংস্কারক, নৈতিক শিক্ষক এবং আল্লাহর প্রতিনিধি। তাঁর প্রতিটি কাজ, আচার-আচরণ, শিক্ষা ও বক্তব্য মানুষের অন্তরে দাগ কাটার মতো হওয়া উচিত। সঠিক দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে সমাজে শান্তি, সৌহার্দ্য, ন্যায়বিচার এবং ঈমানের আলো ছড়িয়ে দেওয়াই একজন মুবাল্লিগের প্রধান উদ্দেশ্য। আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই মহান কাজের উপযুক্ত করে তুলুন—আমিন।
রিপোর্ট: হাসান রেজা
আপনার কমেন্ট